ভুল সিগন্যালে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা
নিরাপদ যাতায়াত মাধ্যম রেল হয়ে পড়ছে অনিরাপদ
- আপলোড সময় : ০৬-০৫-২০২৪ ১০:৩৬:৫৯ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৬-০৫-২০২৪ ১০:৩৬:৫৯ অপরাহ্ন
নিরাপদ যাতায়াত মাধ্যম রেল হয়ে পড়ছে অনিরাপদ
দেশে দিন দিন বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা। বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা এমন খবর প্রায়ই দেখা যায় গণমাধ্যমে। বেসরকারি ও সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, বিগত ১৬ বছরে অন্তত ৮ হাজার রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এতে প্রশ্ন জাগে, যেখানে বিশ্বব্যাপী রেলপথ যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে সুপরিচিত, সেখানে বাংলাদেশের রেলপথ কেন এত অনিরাপদ? যুগের পর যুগ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ট্রেন। অথচ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গত একযুগে রেলের উন্নয়নে খরচ হয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। এত খরচের পরও বাংলাদেশের রেলপথ কেন রয়ে গেছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে? দিনের পর দিন কেন অনিরাপদ হয়ে উঠছে এই পথ? ট্রেনের সংখ্যা ও লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে-কিন্তু সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হচ্ছে না। সিগন্যাল বিভাগে সবচেয়ে কম লোকবল। এ পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করা হলেও ৭০ শতাংশের বেশি স্বল্পতা থেকে যাচ্ছে। ৩০ শতাংশ অদক্ষ লোকবল নিয়ে ট্রেন চলছে। উন্নত বিশে^ সব দেশেই রেলওয়েতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি দেশ ভারতে তাকালেই দেখা যাবে সেখানে প্রায় ২ লাখ কিলোমিটার রেলপথ পরিচালনা করা হয় টেলিকম সিস্টেমে। প্রতিটি জোনে নির্দিষ্ট টেলিকম ব্যবস্থা রয়েছে। চলন্ত ট্রেনের লোকোমাস্টার, পরিচালক, ইঞ্জিন ক্রু, টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রেল পুলিশের হাতে ওয়াকিটকি থাকে। সেই ওয়াকিটকি দিয়ে প্রত্যেকেই কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কোন লাইনে তার সিগন্যাল ক্লিয়ার রয়েছে-সেটা লোকোমাস্টার ওয়াকিটকিতে জানতে পারেন। অথচ বাংলাদেশে সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথের প্রতিদিন সাড়ে ৩শ যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে ব্রিটিশ আমলের সিগন্যাল সিস্টেম দিয়ে যা এখন অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তুলনামূলক ‘নিরাপদ বাহন’ হিসেবে রেল অনেক জনপ্রিয় মাধ্যম হলেও নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং চালক ও সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির কারণে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা। আগে লাইনচ্যুত হয়ে বা অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যেত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে প্রায়ই দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হচ্ছে। এ জন্য রেলওয়ের চালক ও কর্মীদের অবহেলা, ভুল সিগন্যাল বা সিগন্যাল অমান্য করা এবং নানান অনিয়মকেই দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথের ৬৩ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-জয়দেবপুর এবং যশোর-আব্দুলাহপুর ডাবল রেললাইন। বাকি রেললাইন সিঙ্গেল এবং বেশিরভাগই জরাজীর্ণ। তাই প্রতিনিয়ত লাইনচ্যুতিসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে ১ হাজার ১১৬টি ট্রেন দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৩৪৫ জন নিহত এবং ১ হাজার ৩০২ জন আহত হন। যার মধ্যে চার মাসে ঘটে ১৬০টি দুর্ঘটনা। নিহত ১৮ ও আহত হন ২০০ যাত্রী। পরিসংখ্যান বলছে, রেলের এ দুর্ঘটনার প্রায় ৮০ শতাংশই ঘটছে চালক ও স্টেশন মাস্টারদের গাফিলতি এবং লাইনচ্যুতি ও লেভেল ক্রসিংয়ে। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও দুর্বল সেতুর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে ৬৩ শতাংশ। রেল মন্ত্রনালয় সূত্র জানায়, নামমাত্র স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পয়েন্ট থাকলেও ‘ম্যানুয়ালি’ সিগন্যাল ব্যবস্থা একমাত্র ভরসা। রেলের ছোট-বড় দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই ঘটছে সিগন্যাল ব্যবস্থার ক্রুটির কারণে। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলের অধিকাংশ সেকশনে ব্রিটিশ আমলের সিগন্যাল ব্যবস্থা এখনো বিদ্যমান। রেল মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২২-২৩) অনুযায়ী, সারাদেশে ৩১৫টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে ১৪৩টি ট্রেন বিগত ১৫ বছরে চালু করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে নতুন করে ৮৪৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। ১ হাজার ৩৯১ কিলোমিটার রেললাইন মেরামত করা হয়েছে। রেলের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘ দিনের রেল পথ আর মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন খাতে প্রচুর খরচ হলেও তা রেলের জন্য কল্যাণ বয়ে আনেনি। গবেষকরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় এসব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এ ধরনের গাফিলতির কারণে দুটি ট্রেনের সংঘর্ষে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা এর আগেও অনেকবার ঘটেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার কেন ঘটবে? এত দিনেও কেন ট্রেন চালনার সময় চালকদের ওপর নজরদারি, স্টেশন ও ট্রেনের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা চালু করা কিংবা স্বয়ংক্রিয় ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা চালু করা হলো না? সাধারণত টেকনিক্যাল এরর (কারিগরি ত্রুটি) ও হিউম্যান এরর (মনুষ্য ভুল), এই দুটি কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে বলে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য। তাদের মতে, বিগত সময়ে কয়েক বছরের ‘মানুষের ভুলের’ কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। তবে কারিগরি ত্রুটির দুর্ঘটনাও কম নয়। এজন্য সংশ্লিষ্টদের দায়ী করছে তারা।
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ